ধ্বনির উচ্চারণ
উচ্চারণ ঠিক রেখে কবিতা পড়ি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বিখ্যাত কাব্যের মধ্যে আছে 'সোনার তরী', 'চিত্রা', 'বলাকা', 'পুনশ্চ' ইত্যাদি। তিনিই প্রথম বাংলা ছোটোগল্প রচনা করেন। রবীন্দ্রনাথের লেখা উপন্যাসের মধ্যে আছে 'গোরা', 'ঘরে-বাইরে', 'যোগাযোগ', 'শেষের কবিতা' ইত্যাদি। তাঁর লেখা উল্লেখযোগ্য নাটক 'অচলায়তন', 'ডাকঘর', 'রক্তকরবী', 'রাজা' ইত্যাদি।
এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি কবিতা দেওয়া হলো। কবিতাটি কবির 'কাহিনী' কাব্য থেকে নেওয়া। কবিতাটি প্রথমে নীরবে পড়ো; এরপর সরবে পাঠ করো। সরবে পাঠ করার সময়ে খানির উচ্চারণে সতর্ক থাকতে হবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
শুধু বিথে-দুই ছিল মোর তুই আর সবই গেছে ঋণে।
বাবু বলিলেন, 'বুঝেছ উপেন?
এ জমি লইব কিনে।' কহিলাম আমি,
'তুমি ভূস্বামী, ভূমির অন্ত নাই
চেয়ে দেখো মোর আছে বড়ো-জোর মরিবার মতো ঠাঁই।'
শুনি রাজা কহে, 'বাপু, জানো তো হে, করেছি বাগানখানা,
পেলে দুই বিষে প্রন্থে ও দিঘে সমান হইবে টানা-
ওটা দিতে হবে।' কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি
সজল চক্ষে, 'করুন রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।
সপ্তপুরুষ যেথায় মানুষ সে মাটি সোনার বাড়া,
দৈন্যের দায়ে বেচিব সে মায়ে এমনি লক্ষ্মীছাড়া!'
আঁখি করি লাল রাজা ক্ষণকাল রহিল মৌনভাবে,
কহিলেন শেষে ক্রুর হাসি হেসে, 'আচ্ছা, সে দেখা যাবে।'
পরে মাস দেড়ে ভিটে মাটি ছেড়ে বাহির হইনু পথে
করিল ডিক্রি, সকলই বিক্রি মিথ্যা দেনার খতে।
এ জগতে হায় সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি,
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি।
মনে ভাবিলান, মোরে ভগবান রাখিবে না মোহগর্তে,
তাই লিখি দিল বিশ্বনিখিল দু বিঘার পরিবর্তে।
সন্ন্যাসীবেশে ফিরি দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য-
কত হেরিলাম মনোহর ধান, কত মনোরম দৃশ্য।
ভূধরে সাগরে বিজনে নগরে যখন যেখানে ভ্রমি
তবু নিশিদিনে ভুলিতে পারিনে সেই দুই বিঘা জমি।
হাটে মাঠে বাটে এইমতো কাটে বছর পনেরো-যোলো,
একদিন শেষে ফিরিবারে দেশে বড়োই বাসনা হলো।
ধিক ধিক ওরে, শত ধিক তোরে, নিলাজ কুলটা ভূমি,
যখনি যাহার তখনি তাহার-এই কি জননী তুমি।
সে কি মনে হবে একদিন যবে ছিলে দরিদ্রমাতা
আঁচল ভরিয়া রাখিতে ধরিয়া ফলফুল শাক-পাতা।
আজ কোন রীতে কারে ভুলাইতে ধরেছ বিলাসবেশ-
পাঁচরঙা পাতা অঞ্চলে গাঁথা, পুষ্পে খচিত কেশ।
আমি তোর লাগি ফিরেছি বিবাগি গৃহহারা সুখহীন,
তুই হেথা বসি ওরে রাক্ষসী,
হাসিয়া কাটাস দিনা ধনীর আদরে গরব না ধরে। এতই হয়েছ ভিন্ন-
কোনোখানে লেশ নাহি অবশেষ সে দিনের কোনো চিহ্ন।
কল্যাণময়ী ছিলে তুমি অয়ি, ক্ষুধাহরা সুধারাশি।
যত হাসো আজ যত করো সাজ ছিলে দেবী-হলে দাসী।
বিদীর্ণহিয়া ফিরিয়া ফিরিয়া চারি দিকে চেয়ে দেখি-
প্রাচীরের কাছে এখনো যে আছে, সেই আমগাছ একি।
বসি তার তলে নয়নের জলে শান্ত হইল ব্যথা,
একে একে মনে উদিল স্মরণে বালককালের কথা।
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের কড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন-
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!
সহসা বাতাস ফেলি গেল শ্বাস শাখা দুলাইয়া গাছে,
দুটি পাকা ফল লভিল ভূতল আমার কোলের কাছে।
ভাবিলাম মনে, বুঝি এতখনে আমারে চিনিল মাতা।
স্নেহের সে দানে বহু সম্মানে বারেক ঠেকানু মাথা
হেনকালে হায় যমদূতপ্রায় কোথা হতে এলো মালী।
ঝুঁটিবাঁধা উড়ে সপ্তম সুরে পাড়িতে লাগিল গালি।
কহিলাম তবে, 'আমি তো নীরবে দিয়েছি আমার সব-
দুটি ফল তার করি অধিকার, এত তারি কলরব।
চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ;
বাবু ছিপ হাতে পারিষদ-সাথে ধরিতেছিলেন মাছ-
শুনি বিবরণ ক্রোধে তিনি কন, 'মারিয়া করিব খুন।'
বাবু যত বলে পারিষদ-দলে বলে তার শতগুন।
আমি কহিলাম, 'শুধু দুটি আম ভিখ মাগি মহাশয়।'
বাবু কহে হেসে, 'বেটা সাধুবেশে পাকা চোর অতিশয়!'
আমি শুনে হাসি আঁখিজলে ভাসি,
এই ছিল মোরে ঘটে- তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ,
আমি আজ চোর বটে।
(সংক্ষেপিত)
শব্দের অর্থ
উড়ে: ওড়িশার লোক।
উদিল: উদয় হলো।
ক্রুর: নিষ্ঠুর; নির্দয়।
ক্ষুধাহরা: ক্ষুধা দূর করে এমন।
খত: ঋণের দলিল।
ঘটে থাকা: ভাগ্যে থাকা
ঠাই: স্থান
ঠেকানু: ঠেকালাম।
ডিক্রি: আদালতের নির্দেশপত্র
দিযে: দৈর্ঘ্যে
ধ্যান: তীর্থস্থান
হেরিলাম: দেখলাম
সপ্তম সুরে: চড়া গলায়।
লক্ষ্মীছাড়া: দুর্ভাগা।
একেকটি স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের অবস্থান ও ঠোঁটের অবস্থা একেক রকম হয়। 'দুই বিঘা জমি' কবিতা থেকে কিছু শব্দ নিচের তালিকায় দেওয়া হলো। শব্দগুলো বার বার উচ্চারণ করো এবং সহপাঠীদের সাথে আলোচনা করে ছকে থাকা প্রশ্নগুলোর ভিত্তিতে সঠিক উত্তরে টিক চিহ্ন দাও। এরপর শিক্ষকের সহায়তা নিয়ে উত্তরগুলো মিলিয়ে নাও। নিচে প্রথমটি করে দেখানো হলো।
কবিতায় ব্যবহৃত শব্দ | শব্দে থাকা স্বরধ্বনি | ঘরখানিটি উচ্চারণে জিভ কতটুকু উঁচু হয়? | স্বরধ্বনিটি উচ্চারণের সময়ে জিভ সাসনে না পিছনে উঁচু হয়? | স্বরধ্বনিটি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট গোল না প্রসারিত হয়? | স্বরধ্বনিটি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট কতটুকু খোলে? |
---|---|---|---|---|---|
নিলাজ, বিলাস, দাসী | ই |
|
|
|
|
সেই, বটে, হেনকালে, এ জমি | এ |
|
|
|
|
একদিন, একে একে, গেছে | অ্যা |
|
|
|
|
আমি, আনচান, আঁচল | আ |
|
|
|
|
অস্র অবারিত, | অ |
|
|
|
|
ওটা, চোর, মোর | ও |
|
|
|
|
ফুল, দুপুর, বাবু | উ |
|
|
|
|
বাংলা স্বরবর্ণ এগারোটি। কিন্তু মৌলিক স্বরধ্বনির সংখ্যা সাতটি। যথা: ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ। স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ফুসফুস থেকে বেরিয়ে আসা বাতাস বাক্যন্ত্রের কোথাও বাধা পায় না। কিন্তু একেকটি স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে জিভের অবস্থান ও ঠোঁটের অবস্থা একেক রকম হয়।
ই, 'ই' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ উঁচু হয়; তাই এটি উচ্চ স্বরধানি। জিভ সামনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি সম্মুখ স্বরধানি। ঠোঁট প্রসারিত হয়; তাই এটি প্রস্তুত স্বরধানি। ঠোঁট অল্প খোলে; তাই এটি সংবৃত স্বরধ্বনি।
'এ' ঘরখানি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এটি মধ্য স্বরধ্বনি। জিভ সামনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি সম্মুখ স্বরধানি। ঠোঁট প্রসারিত হয়; তাই এটি প্রসূত স্বরধ্বনি। ঠোঁট অল্প খোলে; তাই এটি সংবৃত স্বরধ্বনি।
অ্যা: 'অ্যা' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এটি মধ্য স্বরধ্বনি। জিভ সামনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি সম্মুখ স্বরধ্বনি। ঠোঁট প্রসারিত হয়; তাই এটি প্রসূত স্বরধ্বনি। ঠোঁট বেশি খোলে; তাই এটি বিবৃত স্বরধ্বনি।
আ: 'আ' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ নিচু থাকে; তাই এটি নিম্ন স্বরধানি। জিভ মাঝখানে নিচু থাকে; তাই এটি মধ্য স্বরধানি।
ঠোঁট গোল ও প্রসারিত হয়; তাই এটি গোলাকৃত ও প্রসূত স্বরধ্বনি।
ঠোঁট বেশি খোলে; তাই এটি বিকৃত স্বরধ্বনি।
জ: 'জ' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এটি মধ্য স্বরধ্বনি।
জিভ পিছনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি পশ্চাৎ স্বরধানি।
ঠোঁট গোল হয়; তাই এটি গোলাকৃত অরখানি।
ঠোঁট বেশি খোলে; তাই এটি বিকৃত স্বরধ্বনি।
ও: 'ও' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এটি মধ্য স্বরধানি।
জিভ পিছনের দিকে উঁচু হয়; তাই এটি পশ্চাৎ স্বরধানি।
ঠোঁট গোল হয়; তাই এটি গোলাকৃত স্বরধানি।
ঠোঁট অল্প খোলে; তাই এটি সংবৃত স্বরধ্বনি।
উ: 'উ' স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে-
জিভ উঁচু হয়; তাই এটি উচ্চ স্বরধানি।
জিভ পিছনের দিকে উঁচু হয়, তাই এটি পশ্চাৎ স্বরধানি।
ঠোঁট গোল হয়; ভাই এটি গোলাকৃত স্বরধানি।
ঠোঁট অল্প খোলে; তাই এটি সংবৃত স্বরধ্বনি।
স্বরধ্বনির ছক
জিভের অবস্থান ও ঠোঁটের অবস্থার ভিত্তিতে স্বরধ্বনিগুলোকে এভাবে ছকে দেখানো যায়
সম্মুখ | মধ্য | পশ্চাৎ | |
---|---|---|---|
উচ্চ | ই | উ | |
উচ্চ-মধ্য | এ | ও | |
নিম্ন-মধ্য | অ্যা | অ | |
নিম্ন | আ |
জিভের অবস্থানের ভিত্তিতে স্বরধ্বনি
ই' উচ্চারণের সময়ে জিভ সামনে উঁচু হয়; তাই উপরের ছকে 'ই' স্বরধানিকে সম্মুখ অবস্থানে দেখানো হয়েছে। এর মানে জিভের অবস্থানের ভিত্তিতে 'ই' সম্মুখ স্বরধ্বনি। একইভাবে 'এ', 'অ্যা'-এগুলোও সম্মুখ স্বরধানি। আবার 'উ' উচ্চারণের সময়ে জিভ পিছনে উঁচু হয়; তাই 'উ' স্বরধানিকে পশ্চাৎ অবস্থানে দেখানো হয়েছে। এর মানে জিভের অবস্থানের ভিত্তিতে 'উ' পশ্চাৎ স্বরধানি। একইভাবে 'ও', 'অ'-এগুলোও পশ্চাৎ স্বরধানি। 'আ' উচ্চাদের সময়ে জিভের অবস্থান মাঝখানে থাকে; তাই 'আ' মধ্য স্বরধানি।
যেসব স্বরধানি উচ্চারণে জিভ বেশি উঁচু হয়, সেগুলো উচ্চ স্বরধ্বনি। ই, উ-এ দুটি উচ্চ স্বরধানি। আবার 'আ' উচ্চারণে জিভ নিচু থাকে; তাই এটি নিম্ন স্বরধ্বনি। বাকি স্বরধ্বনিগুলো উচ্চারণের সময়ে জিভ একটু উঁচু হয়; তাই এ, অ্যা, অ, ও মধ্য স্বরধানি।
ঠোঁটের অবস্থার ভিত্তিতে দরকানি
যেসব স্বরধানি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট প্রসারিত হয়, সেগুলোকে বলে প্রসূত স্বরধানি। 'ই', 'এ', 'অ্যা'-এগুলো প্রসূত স্বরধানি। যেসব স্বরধানি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট গোল হয়, সেগুলোকে বলে গোলাকৃত স্বরধ্বনি। 'উ', 'ও', 'অ'-এগুলো গোলাকৃত স্বরধানি।
যেসব স্বরধ্বনি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট কম খোলে, সেগুলোকে বলা হয় সংবৃত স্বরধ্বনি। 'ই', 'এ', 'উ', 'ও'- এগুলো সংবৃত স্বরধ্বনি। আর যেসব স্বরধানি উচ্চারণের সময়ে ঠোঁট বেশি খোলে, সেগুলোকে বলে বিবৃত স্বরধানি। 'অ্যা', 'আ', 'অ'-এগুলো বিবৃত স্বরধ্বনি।
জিভের জড়তা কাটানোর জন্য সাতটি মূল স্বরধ্বনি উচ্চারণের অনুশীলন করো। স্বরধ্বনিগুলো পরপর কয়েকবার সঠিকভাবে এই ক্রমে উচ্চারণ করো: ই, এ, অ্যা, আ, অ, ও, উ। এরপর বিপরীতক্রমে স্বরধানিগুলো কয়েকবার উচ্চারণ করো: উ, ও, অ, আ, অ্যা, এ, ই।
কোনো কোনো স্বরধানি উচ্চারণে আমাদের ভুল হয়ে থাকে। অপর পৃষ্ঠার সারণিতে কিছু শব্দের প্রমিত উচ্চারণ দেখানো হলো।
শব্দ ও বাক্যের উচ্চারণ
হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১) বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে 'আত্মজা ও একটি করবী গাছ', 'জীবন ঘষে আগুন', 'আগুনপাখি' ইত্যাদি। নিচের গল্পটি হাসান আজিজুল হকের 'নামহীন গোত্রহীন' বই থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পটি সরবে পড়ো।
হাসান আজিজুল হক
আমি যুদ্ধে গিইলাম ক্যানো?
দক্ষিণবঙ্গের লোকের কথায় সামান্য যে একটা টান থাকে, সেই টানের সঙ্গে সে বারদুয়েক ভেবে দেখার চেষ্টা করল, আমি যুদ্ধে গিইলাম ক্যানো? বাঁ পায়ের বুটটা সে তখন ছাড়েনি, হাঁটুর উপরে সেটা চেপে ধরে ডান হাতে রাইফেলের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে সে আর একবার কেন যুদ্ধে গিয়েছিল ভেবে দেখার চেষ্টা করে।
আজ বিকেলে হাসপাতাল থেকে চলে আসার সময়ে সে আমিনের মুখের দিকে চেয়ে দেখেনি। হাসপাতালের লোকেরা তাকে লাল কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলে তার কিছুই করতে ইচ্ছে করেনি। আমিন মরে গেলে কম্বল সরিয়ে তার মরা মুখ দেখার জন্যে আলেফ হাসপাতালে তিন দিন বসে ছিল। আসলে আমিন মরে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই তার কাজ ছিল। তার মাকে সে সঠিক খবরটা দিতে চায়। আমিন ফিরে আসবে-এই আশায় অনর্থক কেন বুড়ি বসে থাকবে-তার সম্পর্কে পাকা খবরটা পেলে বরং তার কিছু কাজ হয়। ডান ঠ্যাংটা কেটে ফেলার তিন দিন পর সমস্ত শরীর পচে গিয়ে আমিন মরে গেল।
বাড়ি সে পৌঁছে যায় ভোরের দিকে ঠিকই। যেমন আন্দাজ করেছিল তার অনেক পরে। গাঁয়ের রাস্তায় সে উঠে আসে। ভার পিছু পিছু খালের দিক থেকে একটা ভারী কুয়াশা এসে গাঁয়ের দিকে চলে যায়। আলেফ দেখল তাদের বাড়িটা আগাগোড়া কুয়াশায় মোড়া, বলতে গেলে বাড়িটায় ঢোকার রাস্তা সে প্রথমে খুঁজে পায়নি। বুটজুতো জোড়া সে ফেলে দিয়ে এসেছে, এজন্যে যখন তাদের একমাত্র ঘরের ভাঙা দরজার দিকে এগিয়ে যায়-উঠোন পেরিয়ে সে বেড়ালের মতোই নিঃশব্দে দাওয়ায় ওঠে-কোথাও কোনো শব্দ হয় না। আলেফ দরজায় ধাক্কা না দিয়ে ডাকল, মা।
আলেফ রে, উরে আমার বাপরে! এতদিন কনে ছিলি বাপ?
আমি ফিরে আইছি মা, বাঁচে ছিলি তালি?
তোর জন্যি মরিনি, তোর জন্যি বাঁচে আছি বাপ।
ভালো করিছো-আলেফ হাসে। কুয়াশা খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে যায়।
আলেফের হাসিটা আবছা দেখায়, সে মায়ের মুখটাও ভালো দেখে না।
ভালো ছিলি আলেফ? মা বলে।
হ।
কিছু হয়নি তো তোর?
সামান্য উপদ্রুত মনে হয় আলেফকে। সে বলে, না, কিছু হয়নি। লোক আইছিলো আমার খোঁজ নিতি?
একদিন মিলিটারি আইলো গাঁয়ে আগুন দিতি।
আগুন দিইছে?
হ। আগুন দিইছে, সব বাড়ি পোড়ায়ে দিইছে। কয় ছ্যামড়া আমার বাড়ি আস্যে তর খোঁজ নেলে অনেক। তুমি কি বললে?
আগুনে গাঁ পোড়াতে লাগলো-সেকি আগুন তোরে কবো আলেফ-ছ্যামরা কড়া আমারে কয়-ও বুড়ি
আলেফ কনে?
আমি বললাম, আলেফের খোঁজ জানে কিডা? আমি মরতিছি নিজের জ্বালায়। সে কোঁয়ানে মরতিছে তার আমি কী জানি? আলেফ, আমি ঠিক বলিনি?
ঠিক বলিছো? তোমার আলেফ ছিল কনে কও তো দেখি।
তুই নড়াইয়ে ছিলি বাপ-আলেফের মা সোজা হয়ে দাঁড়াল। বউয়ের দিকে ফিরে আবার বলল বুড়ি, বউ ফিরে আইছে দেহেছিস?
দেহেছি।
বউ যেদিন ফিরলো-বুড়ি বকবক করে। আনন্দে তার ঘাড় নড়বড়ে করে দোলে। মুখ থেকে থুতু ছোটে। মা কিছুতেই থামতে চায় না। আলেফ তাকে অনেকক্ষণ বলতে দিয়ে হঠাৎ বলে, ঠিক আছে মা। বুড়ি চুপ করে। তারপর ঘরের বাইরে চলে যায়। বউ অন্ধকারে কোনে গিয়ে লুকিয়েছে। মা চলে গেলে আলেফ খানিকক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এখন সে কী করবে বুঝতে পারে না। মায়ের নোংরা বিছানার কাছে গিয়ে সে সটান শুয়ে পড়বে কি না, চিন্তা করতে থাকে। ফর্সা হয়ে আসছিল। ভোরবেলাকার ঠান্ডা বাতাস এ সময়ে হু হু করে ঘরে এসে ঢোকে।
দরজাটা বন্ধ করে দে-ঠান্ডা বাতাস আসতিছে- আলেফ বউয়ের দিকে ফিরে বলে। বউ দরজা বন্ধ করতে গেলে আলেফ একবার ঘরের ভিতরটা নজর করে দেখে।
বিশেষ কিছু চোখে পড়ে না। একপাশে তার ব্যাগটা পড়ে আছে। ঘরের কোণে রাইফেলটার নল এই আবছা আলোতেও চকচক করছে। দরজা বন্ধ করে বউ ফিরে আসতে আলেফ ক্লান্ত গলায় বলে, কবে ফিরে আলি তুই? বিড়বিড় করে সে কী বলল বোঝা গেল না। আলেফ হেঁকে উঠল, আ?
বউ বলল, শ্রাবণ মাসে।
ফিরলি ক্যানো?
না ফিরে কী করবো?
তাইলি গিইলি ক্যানো?
লাল ম্যাড়মেড়ে আলোর মধ্যেও আলেফ দেখতে পায়, বউয়ের দুচোখ জলে পরিপূর্ণ হয়ে গেল।
কোথা ছিলি?
মজমপুর।
খাতি পাইছিলি? খাবার জন্যিই তো গিইলি। তা যাতি পাইছিলি তো?
বউ খুব জোরে জোরে মাথা নাড়ল। জমা জল ঝরে পড়ল ঝরঝর করে।
তয়?
আমি অনেকদিন আগে আইছি। তখন তুমি ছিলে না। আমি কোঁয়ানে ছিলাম?
তুমি নড়াইয়ে ছিলে। আলেফ মনে করে দেখল একটু আগে তার মা-ও ঠিক এই কথাটাই বলেছে।
চুপ কর- আলেফ অস্বাভাবিক জোরে চিৎকার করে উঠল। বউ থমকে যায়। আমি মারা যাতিছিলাম জানিস- আলেফ বসে পড়ে লুঙ্গিটা গুটিয়ে হাঁটুর উপরে তুলতে তুলতে বলে, এইখানে গুলি ঢুকিছিল। বউ সেখানেই মাটিতে বসে পড়ে, চোখ খুব কাছে এনে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুকনো ক্ষতটা দেখে। আলেফ নিজেও কোনোদিন ভালো করে দেখেনি। জায়গাটার রং এখনো ফ্যাকাশে সাদা, কাটা আর ছেঁড়া মাংস জোর করে সেলাই করে দেওয়ায় উঁচু হয়ে আছে।
আর এট্টু উফর দিয়ে গেলে হাঁটুর হাড়টা ভাঙে যাতো-আলেফ বলল।
ভালি কী হতো?
হাঁটু খে কাটে ফালায়ে দিতি হতো। আর তাতে হতো কী আমি মরে যাতাম-হাসতে হাসতে এই কথা বলতে গিয়ে আলেফের আমিনের কথা মনে পড়ে গেল।
তোমার কোনো বেকায়দা হয়?
জাংটা এটু খাটো হয়ে গিছে।
আলেফের ভীষন ঘুম পাচ্ছিল। মায়ের ছেঁড়া কাঁথা বিছানো দুর্গন্ধ বিছানার উপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়তে গেলে সে কোমর থেকে পা পর্যন্ত মোটা দড়িটার আর একবার সন্ধান পায়। সে আবার বলে, এই ঠ্যাংটা এটু খাটো হয়ে গিছে। চোখ বন্ধ করেও আলেফ ঘুমাতে পারে না, ঘুম ঘুম গলায় সে জিগ্যেস করে, লড়াই শেষ হয়ে গিছে জানিস? দ্যাশের কী হলো ক দিনি?
দ্যাশ স্বাধীন হইছে-বউ যেন মুখস্থ বলল।
আলেফ প্রায় ঘুমিয়ে পড়ে। যোঁৎ একটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জেগে গিয়ে সে বলে, আমরা রাজা-বাদশা হবো নাকি বল তো? রাজা বাদশা হবানে মনে হয়।
বউ প্রতিবাদ করল, তা ক্যানো? রাজা বাদশা হবো ক্যানো? আমাদের কষ্ট আর থাকবে না।
মানে?
ভাত-কাপড় পাবানি।
ঠিক কচ্ছিস? প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আলেফ চোখ খুলে চেয়ে রইল বউয়ের দিকে। তার মাথায় একটা কথাও
ঢুকছিল না, একঘেয়ে গলায় সে বলল, স্বাধীনতার মানে ভালোই বুঝিছিস বলে মনে হতিছে। কথা শেষ হবার
সঙ্গে সঙ্গে আলেফের নাক ডাকতে শুরু করে, তবে আরো একবার সে আধো ঘুমের মধ্যে বলে ওঠে,
ললিতনগরের খালে চিংড়ি ধরবানে দেহিস, এক একটা চিংড়ি আধসের ওজনের-এই পেল্লায় বড়ো চিংড়ি।
মা বলে, কোথা তোর গুলি লাগিছিলো আর একবার দেখা না বাপ। আলেফ সঙ্গে সঙ্গে হাঁটু মুড়ে বসে গুলি- খাওয়া জায়গাটা বের করে মাকে বোঝাতে শুরু করে, গুলিটা লাগিলো ঠিক এইখানে। আমি ভাবতিছি শালা খানেরা বোধ হয় ভয়ে পলান দিছে। ঝোপ থেকে বেরোয়ে দাঁড়িয়েছি মাত্তর আর সুই করে গুলিটা একেবারে-
তরে সরকার থে ডাকবে না?
আলেফ হাঁ হয়ে যায়, সরকার আমাকে ডাকলে? ক্যানো?
ভোরে ডাকপে না তো কারে ডাকলে? গুলিটা যদি তোর মাথায় লাগতো আলেফ?
তা সরকার আমাকে ডাকপে ক্যানো?
তোরে একা না ডাকুক, তোরা যারা নড়াইয়ে ছিলি তাদের ডাকলে না? আমি আমার এই ভিটের চেহেরা ফেরাবো আলেফ কয়ে দেলাম আর জমি নিবি এট্টু। এট্টা গাই গোরু আর দুটো বলদ কিনবি-আর-
হইছে-তুমি থোও দেহি-আমিনের পচা লাশটার গন্ধ এসে হঠাৎ ভক করে আলেফের নাকে লাগে।
সে বলে, দুটো খাতি দাও, আমি একবার বেনেপুর যাবো।
বেনেপুর যাবি? ক্যানো?
বেনেপুরের এক ছ্যামড়া ছিল আমাদের সাথে। গুলি তার উরতে লাগিলো। হাসপাতালে তার ঠ্যাংটা কাটে ফেলায়ে দিলো। তিন দিনের মদ্যি পচে গন্ধ হয়ে ছ্যামরাটা মরিছে। তার মারে খবরটা দিতে যেতি হবে।
শব্দের অর্থ
'ফেরা' গল্পের কথোপকথনে বহু আঞ্চলিক শব্দ আছে। গল্প থেকে বাছাই করে পনেরোটি আঞ্চলিক শব্দ নিচের ছকের বাম কলামে লেখো। মাঝখানের কলামে শব্দটির প্রমিত রূপ লিখবে এবং ডান কলামে এর প্রমিত উচ্চারণ লিখবে। নিচে দুটি করে দেখানো হলো।
'ফেরা' গল্পের কথোপকথনে ব্যবহৃত দশটি বাক্য নিচের ছকের বাম কলামে লেখো এবং ভান কলানে বাক্যগুলোর প্রমিত রূপ নির্দেশ করো। একটি নমুনা নিচে দেওয়া হলো। কাজ শেষে সহপাঠীদের সঙ্গে উত্তর নিয়ে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করো।
প্রমিত ভাষা
অঞ্চলভেদে ভাষার ভিন্ন ভিন্ন রূপ থাকে। ভাষার এইসব রূপকে বলে আঞ্চলিক ভাষা। কোনো শব্দ অঞ্চলভেদে আলাদাভাবে উচ্চারিত হতে পারে, কিংবা একই অর্থ বোঝাতে আলাদা শব্দের প্রয়োগ হতে পারে। বাক্যের গঠনও অনেক সময়ে আলাদা হয়। আঞ্চলিক ভাষা সাধারণত মানুষের প্রথম ভাষা-এই ভাষাতেই মানুষ কথা বলা শুরু করে। গল্প-উপন্যাস-নাটকে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ দেখা যায়।
ভাষার এই আঞ্চলিক রূপ বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগে কিছু সমস্যা তৈরি করে। সেই সমস্যা দূর করার জন্য ভাষার একটি রূপকে প্রমিত হিসেবে গ্রহণ করা হয়, যাতে সব অঞ্চলের মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে। একই কারণে দেশের যাবতীয় আনুষ্ঠানিক যোগাযোগে, শিক্ষা কার্যক্রমে, দাপ্তরিক কাজে, গণমাধ্যমে, সাহিত্যকর্মে ভাষার প্রমিত রূপ ব্যবহৃত হয়। সকল অঞ্চলের মানুষ সহজে বুঝতে পারে ভাষার এমন রূপের নাম প্রমিত ভাষা।
কথ্য প্রমিত লেখ্য প্রমিত
প্রমিত ভাষার দুটি রূপ আছে: কথা প্রমিত ও লেখ্য প্রমিত। কথা প্রমিত ব্যবহৃত হয় আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলার সময়ে, অন্যদিকে লেখ্য প্রমিত ব্যবহৃত হয় লিখিত যোগাযোগের কাজে।
কবিতা-গল্প-উপন্যাসে কখনো কখনো শব্দের কথ্য প্রমিত রূপ দেখা যায়। তবে আনুষ্ঠানিক গদ্যে শব্দের কথ্য প্রমিত রূপের পরিবর্তে লেখ্য প্রমিত রূপ ব্যবহার করা শ্রেয়। যেমন, শব্দের কথা প্রমিত রূপ-ধুলো, ফিতে, ভেতর ইত্যাদি। এগুলোর লেখা প্রমিত রূপ-ধুলা, ফিতা, ভিতর ইত্যাদি।
নিচের উদাহরণগুলো দেখো এবং লেখার সময়ে বিষয়টি খেয়াল রেখো।
তুমি তোমার চারপাশের মানুষজনের কাছ থেকে শুনে কিছু আঞ্চলিক বাক্য সংগ্রহ করো। নিচের ছকের বাম কলামে সংগৃহীত আঞ্চলিক বাক্যগুলো লেখো। এরপর ভান কলামে বাক্যগুলোকে প্রমিত ভাষায় রূপান্তর করো। বাক্য সংগ্রহের সময়ে খেয়াল রেখো যাতে বিবৃতিবাচক, প্রশ্নবাচক, অনুজ্ঞাবাচক ও আবেগবাচক-সব ধরনের বাক্যই থাকে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) একজন লেখক ও সমাজ-সংস্কারক। 'বর্ণপরিচয়', 'বেতাল পঞ্চবিংশতি', 'ভ্রান্তিবিলাস', 'শকুন্তলা' ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের নাম। হিন্দুসমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলনের জন্য তিনি আন্দোলন করেছিলেন এবং এ ব্যাপারে আইন পাশ করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। নিচে সাধু রীতিতে রচিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের একটি গল্প দেওয়া হলো। গল্পটি লেখকের 'আখ্যানমঞ্জরী' গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
গল্পটি সরবে পড়ো। পড়ার সময়ে সর্বনাম, ক্রিয়াপদ ও অনুসর্গের রূপগুলো খেয়াল করো।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
আলী ইবনে আব্বাস নামে এক ব্যক্তি মানুন নামক খলিফার প্রিয়পাত্র ছিলেন। তিনি বলিয়া গিয়াছেন, আমি একদিন অপরাহ্ণে খলিফার নিকটে বসিয়া আছি, এমন সময়ে হস্তপদবন্ধ এক ব্যক্তি তাঁহার সম্মুখে নীত হইলেন। খলিফা আমার প্রতি এই আড্ডা করিলেন, তুমি এ ব্যক্তিকে আপন আলয়ে লইয়া গিয়া রুদ্ধ করিয়া রাখিবে এবং কলা আমার নিকট উপস্থিত করিবে। তদীয় ভাব দর্শনে স্পষ্ট প্রতীত হইল, তিনি ঐ ব্যক্তির উপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়াছেন। আমি তাঁহাকে আপন আলয়ে আনিয়া অতি সাবধানে রুদ্ধ করিয়া রাখিলাম, কারণ যদি তিনি পালাইয়া যান, আমাকে খলিফার কোপে পতিত হইতে হইবে।
কিয়ৎক্ষণ পরে, আমি তাঁহাকে জিজ্ঞাসিলাম, আপনার নিবাস কোথায়? তিনি বলিলেন, ডেমাস্কাস আমার জন্মস্থান: ঐ নগরের যে অংশে বৃহৎ মসজিদ আছে, তথায় আমার বাস। আমি বলিলাম, ডেমাস্কাস নগরের, বিশেষত যে অংশে আপনার বাস তাহার ওপর, জগদীশ্বরের শুভদৃষ্টি থাকুক। ঐ অংশের অধিবাসী এক ব্যক্তি একসময় আমার প্রাণদান দিয়াছিলেন।
আমার এই কথা শুনিয়া, তিনি সবিশেষ জানিবার নিমিত্ত, ইচ্ছা প্রকাশ করিলে, আমি বলিতে আরম্ভ করিলাম: বহু বৎসর পূর্বে ডেমাস্কাসের শাসনকর্তা পদচ্যুত হইলে, যিনি তদীয় পদে অধিষ্ঠিত হন, আমি তাঁহার সমভিব্যাহারে তথায় গিয়াছিলাম। পদচ্যুত শাসনকর্তা বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া আমাদিগকে আক্রমণ করিলেন। আমি প্রাণভয়ে পালাইয়া, এক সম্ভ্রান্ত লোকের বাড়িতে প্রবিষ্ট হইলাম এবং গৃহস্বামীর নিকট গিয়া, অতি কাতর বচনে প্রার্থনা করিলাম, আপনি কৃপা করিয়া আমার প্রাণ রক্ষা করুন। আমার প্রার্থনাবাক্য শুনিয়া গৃহস্বামী আমায় অভয় প্রদান করিলেন। আমি তদীয় আবাসে, একমাস কাল নির্ভয়ে ও নিরাপদে অবস্থান করিলাম।
একদিন আশ্রয়দাতা আমায় বলিলেন, এ সময়ে অনেক লোক বাগদাদ যাইতেছেন। স্বদেশে প্রতিগমনের পক্ষে আপনি ইহা অপেক্ষা অধিক সুবিধার সময় পাইবেন না। আমি সম্মত হইলাম। আমার সঙ্গে কিছুমাত্র অর্থ ছিল না, লজ্জাবশত আমি তাঁহার নিকট সে কথা ব্যক্ত করিতে পারিলাম না। তিনি, আমার আকার প্রকার দর্শনে, তাহা বুঝিতে পারিলেন, কিন্তু তৎকালে কিছু না বলিয়া, মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন।
তিনি আমার জন্য যে সমস্ত উদ্যোগ করিয়া রাখিয়াছিলেন, প্রস্থান দিবসে তাহা দেখিয়া আমি বিস্ময়াপন্ন হইলাম। একটি উৎকৃষ্ট অশ্ব সুসজ্জিত হইয়া আছে, আর একটি অশ্বের পৃষ্ঠে খাদ্যসামগ্রী স্থাপিত হইয়াছে, আর পথে আমার পরিচর্যা করিবার নিমিত্ত, একটি কৃত্য প্রস্থানার্থে প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছে। প্রস্থান সময় উপস্থিত হইলে, সেই দয়াময়, সদাশয়, আশ্রয়দাতা আমার হস্তে একটি স্বর্ণমুদ্রার খলি দিলেন এবং আমাকে যাত্রীদের নিকটে লইয়া গেলেন। তন্মধ্যে যাহাদের সহিত তাঁহার আত্মীয়তা ছিল, তাঁহাদের সঙ্গে আলাপ করাইয়া দিলেন। আমি আপনকার বসতি স্থানে এই সমস্ত উপকার প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। এজন্য পৃথিবীতে যত স্থান আছে ঐ স্থান আমার সর্বাপেক্ষা প্রিয়।
এই নির্দেশ করিয়া, দুঃখ প্রকাশপূর্বক আমি বলিলাম, আক্ষেপের বিষয় এই, আমি এ পর্যন্ত সেই দয়াময় আশ্রয়দাতার কখনো কোনো উদ্দেশ পাইলাম না। যদি তাঁহার নিকট কোনো অংশে কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের অবসর পাই, তাহা হইলে মৃত্যুকালে আমার কোনো ক্ষোভ থাকে না। এই কথা শুনিবামাত্র, তিনি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, আপনার মনস্কাম পূর্ণ হইয়াছে। আপনি যে ব্যক্তির উল্লেখ করিলেন, সে এই। এই হতভাগ্যই আপনাকে, এক মাসকাল আপন আলয়ে রাখিয়াছিল।
তাঁহার এই কথা শুনিয়া, আমি চমকিয়া উঠিলাম, সবিশেষ অভিনিবেশ সহকারে, কিয়ৎক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া, তাহাকে চিনিতে পারিলাম; আহ্লাদে পুলকিত হইয়া অশ্রুপূর্ণ নয়নে আলিঙ্গন করিলাম; তাঁহার হস্ত ও পদ হইতে লৌহশৃঙ্খল খুলিয়া দিলাম এবং কী দুর্ঘটনাক্রমে তিনি খলিফার কোশে পতিত হইয়াছেন, তাহা জানিবার নিমিত্তে নিতান্ত ব্যগ্র হইলাম। তখন তিনি বলিলেন, কতিপয় নীচপ্রকৃতির লোক ঈর্ষাবশত শত্রুতা করিয়া খলিফার নিকট আমার ওপর উৎকট দোষারোপ করিয়াছে; তজ্জন্য তদীয় আদেশক্রমে হঠাৎ অবরুদ্ধ ও এখানে আনীত হইয়াছি; আসিবার সময় স্ত্রী, পুত্র, কন্যাদিগের সহিত দেখা করিতে দেয় নাই; বোধ করি আমার প্রাণদণ্ড হইবে। অতএব, আপনার নিকট বিনীত বাক্যে প্রার্থনা এই, আপনি অনুগ্রহ করিয়া আমার পরিবারবর্গের নিকট এই সংবাদ পাঠাইয়া দিবেন। তাহা হইলে আমি যথেষ্ট উপকৃত হইব।
তাঁহার এই প্রার্থনা শুনিয়া আমি বলিলাম, না, না, আপনি এক মুহূর্তের জন্যও প্রাণনাশের আশঙ্কা করিবেন না; আপনি এই মুহূর্ত হইতে স্বাধীন; এই বলিয়া পাথেয়স্বরূপ সহস্র স্বর্ণমুদ্রার একটি থলি তাহার হস্তে দিয়া বলিলাম, আপনি অবিলম্বে প্রস্থান করুন এবং স্নেহাস্পদ পরিবারবর্ণের সহিত মিলিত হইয়া সংসারযাত্রা সম্পন্ন করুন। আপনাকে ছাড়িয়া দিলাম, এজন্য আমার ওপর খলিফার মর্মান্তিক ক্রোধ ও দ্বেষ জন্মিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু যদি আপনার প্রাণ রক্ষা করিতে পারি, তাহা হইলে সে জন্য আমি অনুমাত্র দুঃখিত হইব না।
আমার প্রস্তাব শুনিয়া তিনি বলিলেন, আপনি যাহা বলিতেছেন, আমি কখনোই তাহাতে সম্মত হইতে পারিব না। আমি এত নীচাশয় ও স্বার্থপর নহি যে, কিছুকাল পূর্বে, যে প্রাণের রক্ষা করিয়াছি, আপন প্রাণরক্ষার্থে এক্ষণে সেই প্রাণের বিনাশের কারণ হইব। তাহা কখনো হইবে না। যাহাতে খলিফা আমার ওপর অক্রোধ হন, আপনি দয়া করিয়া তাহার যথোপযুক্ত চেষ্টা দেখুন; তাহা হইলেই আপনার প্রকৃত কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা হইবে। যদি আপনার চেষ্টা সফল না হয়, তাহা হইলেও আমার কোনো ক্ষোভ থাকিবে না।
পরদিন প্রাতঃকালে আমি খলিফার নিকট উপস্থিত হইলাম। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, সে লোকটি কোথায়, তাহাকে আনিয়াছ? এই বলিয়া, তিনি ঘাতককে ডাকাইয়া, প্রস্তুত হইতে আদেশ দিলেন। তখন আমি তাঁহার চরণে পতিত হইয়া বিনীত ও কাতর বচনে বলিলাম, ধর্মাবতার, ঐ ব্যক্তির বিষয়ে আমার কিছু বক্তব্য আছে। অনুমতি হইলে সবিশেষে সমস্ত আপনাকে গোচর করি। এই কথা শুনিবামাত্র তাঁহার কোপানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি রোষরক্ত নয়নে বলিলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতেছি, যদি তুমি তাহাকে ছাড়িয়া দিয়া থাক, এই দন্ডে তোমার প্রাণদণ্ড হইবে। তখন আমি বলিলাম, আপনি ইচ্ছা করিলে, এই মুহূর্তে আমার ও তাহার প্রাণদণ্ড করিতে পারেন তাহার সন্দেহ কি। কিন্তু আমি যে নিবেদন করিতে ইচ্ছা করিতেছি, কৃপা করিয়া তাহা শুনিলে আমি চরিতার্থ হই।
এই কথা শুনিয়া খলিফা উদ্ধৃত বচনে বলিলেন, কী বলিতে চাও, বল। তখন সে ব্যক্তি ডেমাস্কাস নগরে কীরূপে আশ্রয়দান ও প্রাণরক্ষা করিয়াছিলেন এবং এক্ষণে তাহাকে ছাড়িয়া দিতে চাহিলে, আমি অবধারিত বিপদে পড়িব, এজন্য তাহাতে কোনোমতে সম্মত হইলেন না, এই দুই বিষয়ে সবিশেষ নির্দেশ করিয়া বলিলাম, ধর্মাবতার, যে ব্যক্তির এরূপ প্রকৃতি ও এরূপ মতি, অর্থাৎ যে ব্যক্তি এমন দয়াশীল, পরোপকারী, ন্যায়পরায়ণ ও সম্বিবেচক তিনি কখনোই দুরাচার নহেন। নীচপ্রকৃতি পরহিংসুক দুরাত্মারা, ঈর্ষাবশত অমূলক দোষারোপ করিয়া তাহার সর্বনাশ করিতে উদ্যত হইয়াছে, নতুবা যাহাতে প্রাণদণ্ড হইতে পারে, তিনি এরূপ কোনো দোষে দূষিত হইতে পারেন, আমার এরূপ বোধ ও বিশ্বাস হয় না। এ ক্ষেত্রে আপনার যেরূপ অভিরুচি হয় করুন।
খলিফা মহামতি ও অতি উন্নতচিত্ত পুরুষ ছিলেন। তিনি এই সকল কথা কর্ণগোচর করিয়া কিয়ৎক্ষণ মৌনাবলম্বন করিয়া রহিলেন; অনন্তর প্রসন্ন বদনে বলিলেন, সে ব্যক্তি যে এরূপ দয়াশীল ও ন্যায়পরায়ণ ইহা অবগত হইয়া আমি অতিশয় অস্ত্রাদিত হইলাম। তিনি প্রাণদণ্ড হইতে অব্যাহতি পাইলেন। বলিতে গেলে তোমা হইতেই তাহার প্রাণরক্ষা হইল। এক্ষণে তাহাকে অবিলম্বে এই সংবাদ দাও ও আমার নিকটে লইয়া আইস।
এই কথা শুনিয়া আহ্লাদের সাগরে মগ্ন হইয়া আমি সত্বর গৃহে প্রত্যাগমনপূর্বক তাঁহাকে খলিফার সম্মুখে উপস্থিত করিলাম। খলিফা অবলোকনমাত্র, প্রীতি-প্রফুল্ললোচনে, সাদর বচনে সম্ভাষণ করিয়া বলিলেন, তুমি যে এরূপ প্রকৃতির লোক তাহা আমি পূর্বে অবগত ছিলাম না। দুষ্টমতি দুরাচারদিগের বাক্য বিশ্বাস করিয়া অকারণে তোমার প্রাণদণ্ড করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম। এক্ষণে ইহার নিকটে তোমার প্রকৃত পরিচয় পাইয়া, সাতিশয় প্রীতিপ্রাপ্ত হইয়াছি। আমি অনুমতি দিতেছি, তুমি আপন আলয়ে প্রস্থান কর। এই বলিয়া খলিফা শ্রীহাকে মহামূল্য পরিচ্ছদ, সুসজ্জিত দশ অশ্ব, দশ অঞ্চর, দশ উষ্ট্র উপহার দিলেন এবং ডেমাস্কাসের রাজপ্রতিনিধির নামে এক অনুরোধপত্র ও পাথেয়স্বরূপ বহুসংখ্যক অর্থ দিয়া তাহাকে বিদায় করিলেন।
শব্দের অর্থ
প্রত্যুপকার' গল্প থেকে সাধু রীতির দশটি বাক্য নিচের ছকে দেওয়া আছে। বাক্যগুলোকে প্রমিত গদ্যরীতিতে রূপান্তর করে ডান কলামে লেখো। কাজ শেষে সহপাঠীদের সঙ্গে আলোচনা করো এবং প্রয়োজনে সংশোধন করে নাও। একটি নমুনা-উত্তর করে দেওয়া হলো।
সাধু রীতি
সাধু রীতি হলো লিখিত বাংলা ভাষার একটি সেকেলে রূপ। একসময়ে লিখিত ভাষার আদর্শ রূপ হিসেবে এটি ব্যবহৃত হতো। উনিশ ও বিশ শতকের প্রচুর সাহিত্যকর্ম এই রীতিতে লেখা হয়েছে। এই রীতিতে কিছু কিছু সর্বনাম, ক্রিয়া ও অনুসর্গের রূপ প্রমিত রীতির তুলনায় সাধারণত দীর্ঘতর হয়। যেমন: তার-তাহার, তোমাদের-তোমাদিগকে, যাবে-যাইবে, ভাবতে লাগল-ভাবিতে লাগিল, হতে হইতে, বাইরে- বাহিরে ইত্যাদি।
তোমরা দলে ভাগ হও। দলের সব সদস্য 'প্রত্যুপকার' গল্পের আলাদা আলাদা অংশ প্রমিত রীতিতে রূপান্তর করে 'আমার বাংলা খাতা'য় লেখো। এরপর দলগতভাবে পুরো কাজটি নিয়ে আলোচনা করো।
আরও দেখুন...